রিকজাভিক এয়ারপোর্টে এসে বসে আছি। বাইরে প্রচন্ড ঝড় বইছে। ভাবলাম, ঝড়টা একটু থামুক তারপরে বেরোই। ঝড় আমি ডরাই। ঢাকা শহরে ঝড় হলে, অতি সহজে বেরোতাম না। বেরোলে মনে হতো- এই বুঝি কারেন্টের খুঁটি উপড়ে গায়ে পড়লো অথবা তার পড়ে শক খেতে খেতে মরে গেলাম। হাজারো শুকুর, ঢাকায় মরি নাই। তার মানে, আইসল্যান্ডে মরবো না এমন কোনো কথা নেই !
তাই সাবধানে আছি।
‘সাবধানের মার নাই।’

কাছাকাছি একটি মেয়ে বসে আছে। তার লাল চুল। রঙ করেনি। আসল চুল। আমি তাকে ডাক দিলাম– “এই চালচুলওয়ালী?”
সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো– “হোয়াট! হোয়াট!”
এইবার ইংরেজিতে বললাম- কিছু না। একটু ‘ ‘মজোক’ করলাম। তোর চুল বড়ই সুন্দর। ফুরফুরা রেশমী। আমাদের দেশী পাটের মতো। ভেজাল নাই। একদম সোনালী আশ। গোলডেন ফাইবার অফ বাংলাদেশ।’
সে কি বুঝলো, জানি না। তবে দেখি মহা খুশী। সে জিজ্ঞেস করলো- বসে আছিস কেন, শহরে যাবি না?
আমি বললাম- ‘ঝড় থামলে যাবো।’
সে বলল- “ঝড় তো সারাদিনই হয়। এদেশে এ রকমই আবহাওয়া।”
ভান ধরলাম কিছুই জানি না। পথঘাট চিনি না।
তাহলে বসে আছি কেন, আমাকে নিয়ে যাবি?
সে অতি উত্তেজনায় খাড়া হয়ে গেলো। বললো- ‘চল’
এয়ারপোর্ট থেকে রাজধানী শহর রিকজাভিকের দিকে যাচ্ছি । ৪০ কিলোমিটার পথ। টানটান সোজা রাস্তা । আঁকাবাঁকা পথঘাট নেই। মানুষই নেই, বাড়িঘর কোথা থেকে আসবে ! তাই রাস্তা সোজা নিতে দোষ কি ! এটা বাংলাদেশ না যে, কার বাড়ীর সামনে দিয়ে রাস্তা যাবে এই নিয়ে ঠেলাঠেলি হবে।

চমৎকার মসৃণ হাইওয়ে। দু’ধারে গাছপালা একটাও নেই। এটা তুন্দ্রা অঞ্চল। মাঠ আর মাঠ। বৃষ্টি ভেজা চকচকে সবুজ ঘাস। ছোটছোট পাহাড়, উঁচু ভুমি। পাহাড়ের রঙ বাদামি কিংবা হলদে মতো কিছু একটা হবে, অতটা মনে নেই এখন। পাহাড়ের গা শ্যাওলা ধরা। পা দিলে হয়তো ফস করে পড়ে যাবো, হাত-পা ভেঙ্গে একাকার হবে। আমি চাঁদের দেশে যাইনি। তবে খটখটে পাথুরে মাঠ আর লাল হলদে বাদামী পাহাড় দেখে মনে হলো, চন্দ্রে অবতরন করেছি।
আসলেই আইসল্যান্ড দেশটা বেশ অদ্ভুত। এর সাথে পৃথিবীর আর পাঁচ সাতটা অন্য দেশের মিল নেই। মনে হয়, আলাদা কোন গ্রহ। সব সময় একটা থ্রিল থ্রিল ভাব আসে ঘোরাঘুরির সময়। মনে হয়- ‘কোথায় এলুম রে বাবা ! ফিরে যেতে পারবো তো !
রিকজাভিক শহরটি অতি মনোহর। সাজানো গোছানো। দেয়ালে দেয়ালে কালির ছিটা নেই, রাস্তায় একটা ময়লাও নেই। সব সময় মনে হবে- কে যেন ধুয়ে মুছে রেখে গেছে এইমাত্র। শহরে বেশ গাছপালা। গাছগুলো বেশি উচু নয়। আবহাওয়া ঠাণ্ডা। কি গ্রীষ্ম, কি শীত। বারো মাস কনকনে হাওয়া। হালকা সোনালী রোদ ওঠে মাঝে সাজে। সে রোদ গায়ে লাগে না। ওম হয় না। কাথা কম্বল জড়িয়েই বসে থাকতে হয়।

ছবি: সংগৃহিত
এই শহরে বিশেষ কোন বিদেশী নেই। থাকলেও, তা সাদা চামড়ার বিদেশী। কালো চোখেই পড়ে না একদম। তবে কিছু আরব দেখেছি বালবাচ্চা কোলে নিয়ে হাঁটছে। হয়তো কেস মেরে বসে গেছে,বাচ্চা কাচ্চা বানিয়ে মহাআনন্দে ভাতা খাচ্ছে। পারতপক্ষে, আইসল্যান্ডের দিকে কেউ পা বাড়ায় না। একবার ইল্লিগ্যাল (Illegal) হয়ে গেলে, একবারে বেঁধে ছেঁদে ভাগিয়ে দেবে। সরাসরি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। চারদিকে সমুদ্র। থৈ থৈ পানি। সীমান্ত পেরিয়ে অন্য দেশে ঘাপটি মারারও উপায় নেই। তাই কেউ আসে না।
আইসল্যান্ডে কোন ক্রাইম নেই। শুধু শান্তি আর শান্তি। তারা আল্লাহ খোদায় বিশ্বাস করে না। কিন্তু এমন শান্তিতে ক্যামনে আছে বুঝি না ! ঝড় ঝঞ্ঝা মহামারীও নেই। কারণ কি জানি না !
- উত্তম বিশ্বাস, ভার্জিনিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।