১৯৮৮ সালে আমার বর যখন প্রথম কানাডার মন্ট্রিল এ আসেন সেসময়ের পরিবেশ আর এখনের সম্পূর্ণ অন্যরকম। আমার দেবর তারও আগে এসেছিলেন স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে। তিনিই লাইন-ঘাট দেখিয়ে আমার বরকে আসতে সাহায্য করেছিলেন।
দেশ থেকে প্লেনে চড়ে আসার পরেও তাদের ভাত খাওয়ার সুযোগ হয়েছিলো ৫ দিন পর। ভাতের ক্ষুধা যে কি! যারা এমন অবস্থায় পরেছিলেন তারাই বুঝতে পারবেন। বার্গার এর মত হাবিজাবি কি আর ভাতের ক্ষুধা মেটাতে পারে? পারে না।
তখন মন্ট্রিল এখনের মত ঘনবসতি ছিল না বলে ঠাণ্ডা ছিল অনেক বেশি। বছরের ৮ মাসই কাটতো চরম ঠাণ্ডায়। কাজ কর্মের সুবিধা থাকলেও জনসংখ্যা কম থাকাতে, নিম্ন সেলারি থাকাতে একটু ভাল জীবনযাপন করতে খাটাখাটনি করতে হতো অনেক বেশি। দেশ থেকে ধার-দেনা করে আসা মানুষের দেশে টাকা পয়সা পাঠানোর দায়িত্ব ছিল বলে কঠোর পরিশ্রমের রেকর্ডও অনেক আছে। শীতের সময়ে এই পরিশ্রম ছিল অবর্ণনীয় ।
বাংলাদেশকে পরিচিত করতে এক সময় বাংলাদেশীদের অনেক কষ্ট করতে হয়েছিলো।বাংলাদেশ থেকে মানুষ তখন কেবল আসতে শুরু করেছে। আমেরিকাতে আসা কিছুটা সহজ হলেও কানাডায় আসা মোটেও সহজ ছিল না। রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে অনেক বাংলাদেশী রিফিউজি ক্লেইম করেছিলেন।
অনেকে জাহাজে কর্মরত অবস্থায় এদেশে নোঙ্গর করতে এসে থেকে গিয়েছেন আর ফিরে যাননি। অনেকেই জীবন বাজি রেখে অন্য দেশ থেকে কপর্দক শুন্য অবস্থায় বর্ডার ক্রস করে এই দেশে এসে বসবাস করতে শুরু করেন, শুধুমাত্র ভালো এবং সুস্থ জীবনের আশায়।
ইমিগ্রেশান পেপার তখন ছিল সোনার হরিণ আর এই সোনার হরিণ হাতে পেতে কারও কারও ৪ থেকে ১০ বছরও সময় লাগতো। আমার বরের লেগেছিল ৩ বছর, পেপার হাতে পেয়েই তিনি আমাদের কে স্পন্সর করেছিলেন। কাগজপত্রের জটিলতায় আমাদের আসতে বেশ খানিকটা দেরী হয়েছিলো। অবশেষে ১৯৯৫ সালে আমি আমার ছেলেকে নিয়ে এদেশে পাড়ি জমায়।
বাংলাদেশীরা তখন সব জায়গায় ছড়িয়ে না থেকে কিছু কিছু এরিয়া ধরে বাস করতে শুরু করেন। যাতায়াতের সুবিধা, চাকুরী, স্কুল কলেজের সুবিধা, কেনা-কাটার সুবিধার্থে এভাবেই তারা বাস করতে শুরু করেন।
মন্ট্রিলের জনসংখ্যা এখনের মতো এতো বেশি ছিল না। বাংলাদেশী সবজি, মাছ, মশলাপাতি এসব পাওয়া ছিল আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতই। বাংলাদেশী দোকানপাট ছিল একদম হাতে গোনা কয়েকটি। বাংলাদেশীরা বাজার-সদাই করতেন মূলত ইন্ডিয়ান এবং চাইনিজ দোকান থেকে। হালাল খাবারের বাছ-বিচার নিজেদের মধ্যেই করতে হতো।
অল্প কিছু বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা ইন্ডিয়ান ব্যবসায়ীদের সাথে পেরে উঠছিলেন না। সামান্য ধনে পাতার জন্যও মানুষ তীর্থের কাকের মতই অপেক্ষা করতেন। সেই সুযোগে অন্যদেশি ব্যবসায়ীরাও লুফে নিয়েছিলো মোটা অংকের মুনাফা।
কিছু কিছু বাঙালী পরিবার গ্রীষ্মকাল শুরু হতেই নিজেদের উঠানে, বারান্দায় বাগান করা শুরু করেন। সরকার জায়গা লিজ দেয় ক্ষেত খামার করার জন্য। দেশ থেকে বীজ এনে তা দিয়ে দেশী শাক সবজি চাষ শুরু করেন। মাটির উর্বরতার কারনে বিপুল ফলন হতে থাকে। নিজেদের চাহিদা মিটিয়েও পরিচিতদের বিলিয়ে দিতেন, তবুও যেন শেষ হতো না।
অনেকে নিজের জমি থেকে অনেক শাক সবজি বিক্রির জন্য দেশি দোকানগুলোতে দিতে শুরু করেন। শুধুমাত্র গরমের চার মাসই তাদের এই সুযোগ ছিল। ঠাণ্ডার মৌসুমে ৮ মাস ক্ষেতে চাষ করা সম্ভব হতো না। তখন দোকানের সেই ফ্রেশ ধনে পাতা, লাউ, শিমের খবর পেলেই দূর-দুরান্ত থেকে ড্রাইভ করে বাঙালীরা আসতেন সেসব কিনতে। সামান্য এক আঁটি ধনে পাতাও অনেক দাম দিয়ে বিক্রি হতো, আর মানুষ খাবার-দাবারে দেশি স্বাদের ছোঁয়া পাওয়ার আশায় তা কিনে নিয়ে যেতেন।
এরপর আসা শুরু করলো দেশি মাছের হিমায়িত ব্লক , রাঁধুনির নানান প্রকার রেডি মশলা, শুঁটকি, হিমায়িত সবজি, যেমন, কচুর লতি, মুখী, কাঁঠালের বীচি, শিম বীচি এই ধরনের প্যাকেট। যারা একা থাকতেন তারা যেন হাতে সোনার হরিণ পেয়ে গেলেন এবং সেসব দোকানের ব্যবসাও রঙিন হতে শুরু করলো। মানুষের চাহিদা মেটাতে তাদের রীতিমত হিমসিম খেতে হতো। আমি যখন আসি ১৯৯৫ সালে তখনও দেখতাম খুব কম দোকানেই দেশি জিনিষ পাওয়া যায়।
দেশি ব্যাবসায়ীরা আস্তে আস্তে দেশীয় পণ্য আনার ব্যপারে আগ্রহী হতে শুরু করলো। অনেকেই ব্যাবসা বাড়াতে শুরু করলো কাস্টমার ধরার জন্য কিছু কিছু গ্রোসারিতে ভিডিও ক্যাসেট ভাড়া দেয়ার ব্যবস্থাও রাখতে শুরু করলো।
মন্ট্রিলের আশে পাশে যেসব শহরে বাংলাদেশী দোকানপাট নেই, আর থাকলেও দেশি জিনিষ পাওয়া যেত না, সেসব শহর থেকে মানুষ দুই তিন ঘন্টা ড্রাইভ করেও মন্ট্রিল আসতেন, শুধু মাত্র বাজার করতে। তারা গাড়ি ভর্তি করে সারা মাসের বাজার করে নিয়ে যেতেন।
সময়ের সাথে সাথে বাংলাদেশীদের কাজ-কর্মের সুনাম ছড়িয়ে পরতে থাকে। বদলে যেতে থাকে বাংলাদেশীদের ভাবমূর্তি।মানুষ নানানভাবে এসে, তাদের আত্মীয় স্বজন এনে মন্ট্রিলের জনসংখ্যা বাড়াতে লাগলেন। বাংলাদেশীরাও আর পিছিয়ে থাকলো না। তারা তখন ইন্ডিয়ান দোকানপাটে কেনা-কাটা কমিয়ে দিতে থাকলো।
বাংলাদেশীদের মনে হতে লাগলো একটু দাম বেশি হলেও আমরা দেশী দোকান থেকেই কিনবো, পয়সা আমরা দেশি মানুষকে দেবো। ইন্ডিয়ান দোকানের বিশাল বাংলাদেশী কাস্টমার দের ফিরিয়ে আনার জন্য তারা নানান পাঁয়তারা করতে লাগলো।
তারা তখন তাদের দোকানেও বাংলাদেশী খাবার দাবার, মশলাপাতি, মাছ, শুঁটকিও রাখা শুরু করে দিলো। এই ধরনের ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা সাধারন জনগণের জন্য সুবাতাস এনে দিলো। বিদেশিরা বাংলাদেশের নাম জানতে শুরু করলো।
এসব চাহিদার কথা ভেবেই কানাডার সরকার গ্রীন হাউজেই দেশি বিদেশি শাক-সবজি, ফলমূল চাষের উদ্যোগ নিলেন। ধনে পাতাও স্থায়ী হয়ে গেলো অনেক বিদেশি দোকানের বিদেশি সবজির সঙ্গী হয়ে। বিদেশিরাও নানানভাবে অন্য দেশি খাবার-দাবারের স্বাদ পেতে শুরু করলো। গড়ে উঠলো বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট, তবে আমাদের দেশের নাম তেমন পরিচিত ছিল না বলে, ভারতীয় রেস্টুরেন্টের নাম দিয়ে চালানো হতো।
তখনও বিদেশীরা বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া, পাকিস্থান, শ্রীলংকাকে আলাদা করতে পারতো না। এসব জায়গার সব মানুষকেই ইন্ডিয়ান ভাবতো। ইন্ডিয়ানরা অনেক আগে থেকেই তাদের অবস্থান পোক্ত করে একচেটিয়া আধিপত্য চালিয়ে যাচ্ছিলো। পাকিস্থান, শ্রীলংকা ইন্ডিয়ার সাথে পেরে উঠছিল না। তাদেরকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে শুরু করলো দৃঢ় পদক্ষেপে। তাদের সততার সুনাম ছড়িয়ে পরতে লাগলো নানান ভাবে।
বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি, অফিস আদালতেও বাংলাদেশীরা নিজেদের সততার নানান প্রমান দিয়ে উচ্চ শ্রেণীর মানুষদের নজর কাড়তে শুরু করে। বাংলা ভাষাভাষীর নানান সাংস্কৃতিক সম্মেলন, মেলা, নববর্ষ, ঈদ, পূজার সুনামও দিকে দিকে ছড়িয়ে পরতে শুরু করে।
বাংলাদেশী বললেই এখন মানুষ আর অচেনা মনে করে না। নিজেদের অবস্থান সুনাম ভালো রেকর্ড পাকিস্থান শ্রীলংকা কে পেছনে ফেলে দিলো। আস্তে আস্তে বাংলাদেশীরা তাদের সন্মান জনক অবস্থান পাকাপাকি ভাবেই পোক্ত করে নেয়।
- জেন্নিফার চয়নিকা, মন্ট্রিল, কানাডা
আরও পড়ুন- মরুর দেশ কাতারে প্রবাসীর প্রথম রমজান
প্রবাসীদের সব খবর জানতে; প্রবাস কথার ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে সাথে থাকুন